স্বাধীন বাংলার প্রথম জনসভার ঐতিহাসিক মঞ্চ পুনঃনির্মাণের মাধ্যমে সংরক্ষণ, সংবর্ধনা………….
১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর যশোর টাউন হল ময়দানে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী সরকারের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। হানাদার মুক্ত বাংলার প্রথম এ জনসভায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বক্তব্য রাখেন। যে মঞ্চে এই জনসভা হয়েছিল সেটি ঐতিহাসিক স্বাধীনতা উন্মুক্ত মঞ্চ হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এই মঞ্চটি সংরক্ষণের জন্য পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। যশোর জেলা পরিষদ মঞ্চটি নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরেছে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কেবল মঞ্চ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। প্রয়োজন না থাকলেও মঞ্চের সামনের টাউন হল ময়দানে মাটি ভরাট ও ফুটপাত নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের সাথেই যশোর ইনস্টিটিউটের কমনরুম সংস্কার, নতুন করে সাধারণ সম্পাদকের কক্ষ ও বাথরুম নির্মাণের জন্য আরেকটি প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে এক কোটি ৬০ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। মঞ্চ নির্মাণ ও ইনস্টিটিউটের সংস্কার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ৭ ডিসেম্বর দেয়া হয়েছে মাটি ভরাট কাজের দরপত্র বিজ্ঞপ্তি।
যশোর টাউন হল ময়দানের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা উন্মুক্ত মঞ্চের পুনঃনির্মাণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রবিবার বিকেলে এই মঞ্চের উদ্বোধন ও স্বাধীন দেশের জনসভার প্রথম জনসভার আলোকচিত্রী কুষ্টিয়ার সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ রায়হানকে সম্মাননা দেয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর আজকের দিনে হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত যশোরের এই মঞ্চে স্বাধীন বাংলার প্রথম জনসভায় মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সবাইকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যশোর জেলা পরিষদ মঞ্চটি সংরক্ষণে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে তা পুনঃনির্মাণ করেছে।
যশোরের জেলা প্রশাসক মোঃ তমিজুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি।
প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সকল স্থাপনা সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলার প্রথম জনসভার এই মঞ্চটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর ফলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে।
অনুষ্ঠানে যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুজ্জামান পিকুল, যশোর পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার গণী খান পলাশ, তৎকালীন মুজিবাহিনি প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন মনি, মুজিবাহিনি উপ-প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট রবিউল আলম যশোর ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানের শেষে স্বাধীন বাংলার প্রথম জনসভার ছবির আলোকচিত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ রায়হানকে সম্মাননা স্মারক প্রদান, উত্তরীয় ও চাদর পরিয়ে দেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি।
সম্মাননাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ রায়হান তার অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, আমি অভিভূত! ঐতিহাসিক সেই জনসভার ৫১ বছর পর আপনারা আমাকে স্মরণ করেছেন, সেকারণে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। যশোরবাসীকে আমার অনুভূতি প্রকাশ করা কঠিন।
কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর দুই দফায় জনসভায় সশরীরে উপস্থিত এবং তাদের খাওয়ানোর দায়িত্বে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ রায়হান বলেন, ১৯৭০ এবং ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু হুষ্টিয়ার জনসভায় এলে আমি বাড়ি থেকে তার জন্যে গরুর দুধ নিয়ে গেছি। তিনি খেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব ভালবাসতেন। আজ তিনি নেই। তার কারণেই দেশ আজ অনেক দূর এগিয়েছে।
৫১ বছর পর সংবর্ধিত হলেন আলোকচিত্রী হামিদ রায়হান
যশোর ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে রোববার বিকেলে পুনর্নির্মিত স্বাধীনতা উন্মুক্ত মঞ্চ উদ্বোধন এবং সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাতীয় সংগীতের পর প্রধান অতিথি হিসেবে স্বাধীনতা উন্মুক্ত মঞ্চ এবং টাউনহল মাঠের উন্নয়ন কাজের ফলক উন্মোচন করেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি।
পরে স্বাধীনতা উন্মুক্ত মঞ্চে যশোরের জেলা প্রশাসক ও ইনস্টিটিউটের সভাপতি তমিজুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন যেখানে যা আছে তা সংরক্ষণ করতে হবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এবং মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও যশোরবাসীর চাওয়ার প্রেক্ষিতে তিনি পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেন। মঞ্চ এবং টাউনহল মাঠের উন্নয়ন কাজে দেড়কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলন, মঞ্চ পুনর্নির্মাণের জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল এরমধ্যে ৪৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। ৮৮ লাখ টাকার টেন্ডার রয়েছে। এই টাকা টাউনহল মাঠের সৌন্দর্য্য বর্ধনের কাজে ব্যবহার হবে। প্রধান অতিথি আরও বলেন, ৭৫ পরবর্তী সময়ে দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ভার নেওয়ার পর দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর যশোরের মুজিব বাহিনী-বিএলএফের অধিনায়ক আলী হোসেন মনি, সহঅধিনায়ক অ্যাডভোকেট রবিউল আলম, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল ও পৌরমেয়র হায়দার গণি খান পলাশ। আবেগ আপ্লুত হয়ে অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন সংবর্ধিত অতিথি আলোকচিত্রী আব্দুল হামিদ রায়হান। ইনস্টিটিউটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রওশন আরা রাসু ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মনিরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার আবুল কালাম আজাদ লিটু।
দেশপ্রেম আর আপন জেলার গৌরবময় ইতিহাসের গর্বে গর্বিত হয়ে অনুষ্ঠানে হাজির হন যশোরের বীরমুক্তিযোদ্ধা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, জনপ্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
আলোচনা ও সম্মাননা পর্ব শেষে যশোরের শিল্পীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনার পাশাপাশি অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল আব্দুল হামিদ রায়হানের ‘সেই’ ইয়াসিকা ৬৩৫ মডেলের ক্যামেরা। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সেই জনসভায় তোলা ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় অনুষ্ঠানস্থলে।